এক বছর ধরে নিস্তব্ধ থাকা সীমান্তে আবারও শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং সীমান্তের পরিবারের মধ্যে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে গোলাগুলি ও মর্টারশেল বিস্ফোরণ শুরু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জনপদে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরাসরি গুলির প্রভাব পড়ছে ঘরবাড়িতে, যার কারণে নারী-শিশু ও বৃদ্ধসহ প্রায় আট হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকিতে
এক বছর ধরে নিস্তব্ধ থাকা সীমান্তে আবারও শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং সীমান্তের পরিবারের মধ্যে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে গোলাগুলি ও মর্টারশেল বিস্ফোরণ শুরু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জনপদে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরাসরি গুলির প্রভাব পড়ছে ঘরবাড়িতে, যার কারণে নারী-শিশু ও বৃদ্ধসহ প্রায় আট হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকিতে পড়েছেন। একই সঙ্গে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে নাফ নদীর জেলেরা, যারা তাদের পেশা হারানোর দুশ্চিন্তায় আছেন।
সম্প্রতি তথ্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গত শনিবার ভোর ৫টার দিকে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্য মংডু টাউনশিপের উত্তরাংশে ব্যাপক গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। বলিবাজার, সায়েরবিল ও নাফ নদের তোতার দ্বীপসংলগ্ন এলাকায় এই সংঘর্ষ চলছিল। এই শব্দের কম্পনে বাংলাদেশের হোয়াইক্যং সীমান্তের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ঘুম থেকে উঠে ঘরের ভেতরে আশ্রয় নেন। চোখে পড়ে, তারা দরজা-জানালা বন্ধ করে পরিবারসহ এক কোণে গুঁতো খাচ্ছেন।
আনুসন্ধানে জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে পুনরায় আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো দখলের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি, আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে তিনটি রোহিঙ্গা উগ্র গোষ্ঠী—আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরআরএসও) এবং নবী হোসেনের নেতৃত্বাধীন একদল সশস্ত্র যোদ্ধা। এই সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু প্রধানত নাফ নদীর বুকের উপরে অবস্থিত তোতার দিয়া, হাসিমের দিয়া ও হসের দিয়া দ্বীপ।
স্থানীয়রা বলছেন, এই দ্বীপটি বর্তমানে আর্মি দখলে রয়েছে। এই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠছে। অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও মানবপাচারের বড় রুট হিসেবে এই দ্বীপের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ। নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলমান থাকায় পরিস্থিতি দিন দিন আরো জটিল হয়ে উঠছে, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডেও।
উল্লেখ্য, গত বছর ৮ ডিসেম্বর মিয়ানমারের সরকারী বাহিনীকে সরিয়ে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকা আর্মি দখল করে নেয়। এরপর প্রায় এক বছর কোনও বড় ধরনের গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি, ফলে সীমান্তবাসীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি শুরু হওয়া এই গোলাগুলির কারণে আবারও দুঃস্বপ্নে ফিরেছেন তারা। গত এক মাসে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি বাংলাদেশের হোয়াইক্যং এলাকার বিভিন্ন গ্রামে এসে পড়েছে।
হোয়াইক্যংয়ের বালুখালী গ্রামের বাসিন্দা শামসুন নাহার জানিয়েছেন, ‘গোলাগুলির শব্দ শুনে শিশু-কিশোররা কান্নাকাটি করে ঘরে ঢুকে যায়। আমি ভয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি। পরে বাইরে গিয়ে দেখি, বাড়ির কাছে বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের দিকে গুলি ছোড়া হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমার শরীর কেঁপে ওঠে। গুলির শব্দ শেষ হয়ে গেলে দেখি, আমার ঘরের দেওয়ালে ফাটল হয়েছে। এখন রাতে ঘুম হয় না।’
একই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘একটি গুলি এসে আমার ঘরের টিনের চাল ভেদ করে ভেতরে পড়ে। আমি অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।’
সরওয়ার আলম জানান, ‘বিরতির জন্য আমি ও আমার পরিবার ঘরের এক কোণে আশ্রয় নিই। হঠাৎ বিকট শব্দে গুলি ছাদ ভেদ করে ভেতরে পড়ে, মনে হয়েছিল এবার শেষ হয়ে গেলাম।’
নাফ নদীর পাড়ে থাকা হোয়াইক্যং এলাকায় প্রায় ১,২০০ জেলেপরিবার বাস করেন। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ পরিবার সরাসরি সীমান্তের কাছাকাছি বাস করছে। গোলাগুলির কারণে তারা নদীতে যেতে পারছেন না, যাতে করে তাদের পেশা চালানো অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। জেলে হাফিজ উল্লাহ বলেন, ‘গুলির শব্দ শুনে বিজিবি আমাদের বাইরে বের হতে মানা করে। নদীতে নামার সাহস নেই। এই পরিস্থিতিতে পেট রানার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।’
শিক্ষার্থী মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘অন্তর্ধর্মে নিজ দেশের সঙ্গে যারা যুদ্ধ করছে, আমরা তা বুঝতে পারি। কিন্তু আমাদের সীমান্তে গুলি ছুঁড়ে কেন? বাংলাদেশ এ বিষয়ে কোনও প্রতিবাদ জানাচ্ছে না?’।
উপজেলা ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু বলেন, ‘উত্তরপাড়া, কোনাপাড়া, তুলাতলী, খারাইংগা ঘোনা ও বালুখালী গ্রামের অন্তত আট হাজার মানুষ খুবই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ‘গুলিতে টিনের চাল ফুটো হয়ে যাচ্ছে, মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমামুল হাফিজ নাদিম বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় অবান্তর চলাচল এড়াতে স্থানীয়দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিজিবির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’ অন্যদিকে, উখিয়া সীমান্তের ৬৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জসিম উদ্দিন জানান, ‘হোয়াইক্যংয়ের পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’
সর্বশেষ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের আগুন আবারও বাংলাদেশের সীমান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। গোলার শব্দে কাঁপছে জনপদ, থমকে যাচ্ছে জীবিকা, ভয়ংকর হয়ে উঠছে শিশুদের চোখের সামনে থাকা পরিস্থিতি।











