মোবাইল আর্থিক সেবা অর্থনীতিতে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

মোবাইল আর্থিক সেবা অর্থনীতিতে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

বাংলাদেশের এগিয়ে চলা অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে মোবাইল আর্থিক সেবা। এখন দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশের প্রতি মুহূর্তের আর্থিক প্রয়োজনে অপরিহার্য ব্যাপার হয়ে উঠেছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি এখন দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে মানুষের নগদ টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে। বর্তমানে দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের তথা এমএফএস সেবার

বাংলাদেশের এগিয়ে চলা অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে মোবাইল আর্থিক সেবা। এখন দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশের প্রতি মুহূর্তের আর্থিক প্রয়োজনে অপরিহার্য ব্যাপার হয়ে উঠেছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি এখন দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে মানুষের নগদ টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে। বর্তমানে দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের তথা এমএফএস সেবার গ্রাহক।

সর্বশেষ, গত জানুয়ারি ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানেই এই আর্থিক সেবার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। তবে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ কোটির কাছাকাছি। ১২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের দেশে এ সংখ্যা কোনোভাবেই কম বলার উপায় নেই। ব্যাংকে না গিয়ে দৈনন্দিন ছোট ছোট নানা প্রয়োজনে মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছে। ছোটখাটো লেনদেনে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। বিশেষ করে নানা ধরনের পরিষেবা বিল (বিদ্যু, ওয়াসা, গ্যাস, টেলিফোন) পরিশোধ, স্কুল-কলেজের বেতন, অনলাইনে কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, পেনশন, বাস ট্রেন থেকে শুরু করে প্লেনের টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, বিভিন্ন অনুদান, সাহায্য ইত্যাদি প্রদানে আজকাল চট করেই মোবাইল আর্থিক সেবার কথা ভাবছে সবাই। বর্তমানে খুব সহজেই ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা আনা সম্ভব হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে। আবার মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব থেকেও ব্যাংকে টাকা জমা করা যাচ্ছে।

ক্রেডিট কার্ড কিংবা ব্যাংকঋণের কিস্তির টাকাও জমা দেওয়া যাচ্ছে এর মাধ্যমে। এভাবেই শহর, বন্দর এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের সব শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে থাকা মোবাইল ফোনটি যেন নিজের জন্য একটি ব্যাংক হয়ে উঠছে। আগে ব্যাংক শাখায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের সেবা গ্রহণে যে সময় ও শ্রম ব্যয় হতো তা এখন পুরোটাই লাঘব হয়েছে মোবাইল আর্থিক সেবার দ্রুত বিকাশ এবং চমৎকার গতিশীলতার কারণে।

২০১১ সালের মার্চে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবার দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। গত একদশক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা। ঘরে ঘরে এখন এর ব্যাপক ব্যবহার চলছে। বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরবর্তীকালে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস চালু করে বিকাশ। পরবর্তী সময়ে আরো অনেক ব্যাংক মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার আলাদা আলাদা প্রকল্প চালু করে। বর্তমানে দেশের ১৫টি ব্যাংক মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদান করছে। বিকাশ, রকেট, নগদ, ইউক্যাশ প্রভৃতি মিলিয়ে দেশে এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা গ্রহণকারী গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ কোটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি শেষে এ সেবার গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ৫ লাখ।

জানুয়ারিতে গড়ে দৈনিক লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। বর্তমানে মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তুলনামূলক বেশি সুযোগ সুবিধা প্রদান এবং অপেক্ষাকৃত কম মাশুলে আর্থিক সেবা প্রদানে কে কার চেয়ে বেশি এগিয়ে থাকতে পারে তার প্রতিযোগিতা এক্ষেত্রে চমৎকার গতির সঞ্চার করেছে সন্দেহ নেই। অতীতে ব্যাংকের কিংবা ডাকঘরের মানি অর্ডারের মাধ্যমে আত্মীয় পরিবার-পরিজন কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে আর্থিক স্থানান্তরে দীর্ঘ সময় লাগতো। যথাসময়ে টাকা প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে অসত্ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ডাকঘরের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় বোধ করতেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং এর বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া সম্ভব। মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম এতদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালু থাকলেও বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। ডিজিটাল লাইফ স্টাইলে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা। এর ফলে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ সাশ্রয়ী ও নিরাপদ ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে খুব সহজেই। এমনিতেই বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার পূরণে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আধুনিক ও ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর করতে ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

এ ধরনের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি। এ সেবার মাধ্যমে যদি দেশের শতকরা ৫০ ভাগ মোবাইল ফোন গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যায় তাহলে আমাদের সবার জীবনযাপনে গতির সঞ্চার হবে আরো অনেক বেশি। ব্যাংকে যাওয়া-আসার ঝক্কিঝামেলা থেকে বেঁচে যাবেন বেশির ভাগ গ্রাহক। ঘরে বসে কিংবা নিজের অফিসে বসেই ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে পারবেন। বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যাংকই জোর তত্পরতা শুরু করে দিয়েছে। ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে এসএমএম ব্যাংকিং। এ সুবিধা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট শাখার গ্রাহক হতে হয়। নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফরম, নমুনা স্বাক্ষরসহ স্পেফিসেকেশন সিগনেচার পূরণ করে শাখায় জমা দিয়ে রেজিস্টার্ড সদস্য হতে হয়। ব্যাংকের কোনো নতুন পণ্য/সেবা, ব্যাংকিং অথবা অন্যান্য তথ্য ইত্যাদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসএমএস-এর মাধ্যমে পেতে হলে অবশ্যই অ্যাকাউন্ট হোল্ডার মানে হিসাবধারীকে এসএমএস ব্যাংকিংয়ের রেজিস্ট্রার্ড সদস্য হতে হবে। এসএমএস-এর মাধ্যমে অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স লেনদেনের সংক্ষিপ্ত বিবরণী, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার (ফরেন্স কারেন্সি রেট) মেয়াদি ও সঞ্চয়ী হিসাবে মুনাফার হার ইত্যাদি জানা সম্ভব হচ্ছে।

মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকৃত অনলাইন ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা যাচ্ছে। সারা দেশের যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময়ে ব্যাংকিং সেবা প্রদান সহজতর হয়ে উঠেছে। এটা তুলনামূলকভাবে বেশ সুবিধাজনক, সহজলভ্য ও নিরাপদও বটে। মোবাইল ব্যাংকিং-এ পরিচালিত সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রাহক নিবন্ধন, নগদ টাকা জমাদান, নগদ টাকা তোলা, যা ব্যাংক মনোনীত এজেন্টরা তাদের নিজস্ব মোবাইল থেকে লেনদেন পরিচালনা করবেন। এ ধরনের ব্যাংকিং সেবা বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। অন্যদিকে মার্চেন্ট পরিচালিত সেবার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটার বিল পরিশোধ। কিন্তু এখন মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ব্যাপকভাবে চালু হওয়ায় অতীতের যত দুর্ভোগ, কষ্ট, যন্ত্রণার অবসান হয়েছে।

বর্তমান করোনাকালীন সংকটময় সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার আরো বেশি বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যাংকে গিয়ে আর্থিক সেবা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না সবার পক্ষে। কারণ, মানুষজনের ভিড়ভাট্টার মধ্যে ব্যাংকে যাওয়াটাকে ঝুঁকিবহুল মনে করে অনেকেই আজকাল মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজন সারছেন। একজন শিল্পকারখানার মালিকের জন্য যেমন সুবিধা করে দিয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, তেমনিভাবে কারখানার সাধারণ শ্রমিকের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। কারণ, এখন আর আগের মত মাস শেষে ব্যাংক থেকে বস্তাভর্তি করে টাকা এনে কারখানার শ্রমিকদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বেতন দিতে হয় না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাস শেষে বেতনভাতার টাকা চলে যাচ্ছে শ্রমিকদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে। সাধারণ আয়ের মানুষেরা সপ্তাহ শেষে উপার্জিত যে টাকা গ্রামে থাকা পরিবারের কাছে অনেক ঝুঁকি নিয়ে পাঠাত সেই ঝুঁকির দিন এখন আর নেই। কারণ, এখন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দিনে দিনেই টাকা দূর গ্রামের বাড়িতে পরিবার পরিজনের কাছে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে।

Staff Reporter
ADMINISTRATOR
PROFILE

Posts Carousel

Latest Posts

Top Authors

Most Commented

Featured Videos