সিঙ্গাপুরে হেফাজতের নামে আনসারুল্লাহর অর্থ সংগ্রহ

হেফাজতে ইসলামের ২০১৩ সালের ৫ মে’র সমাবেশে ‘আহতদের’ পুনর্বাসনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ১৪ জন ‘অনুসারী’। যাদের সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটির সরকার। এরা বিভিন্ন সময় উগ্রপন্থী কয়েকটি সংগঠনকেও টাকা পাঠিয়েছে। কারাবন্দি এবিটি’র প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মাধ্যমে তারা সংগৃহীত অর্থ উগ্রপন্থী দলগুলোর

হেফাজতে ইসলামের ২০১৩ সালের ৫ মে’র সমাবেশে ‘আহতদের’ পুনর্বাসনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ১৪ জন ‘অনুসারী’। যাদের সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটির সরকার। এরা বিভিন্ন সময় উগ্রপন্থী কয়েকটি সংগঠনকেও টাকা পাঠিয়েছে। কারাবন্দি এবিটি’র প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মাধ্যমে তারা সংগৃহীত অর্থ উগ্রপন্থী দলগুলোর কাছে পাঠাত। গ্রেফতার ১৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য মিলেছে বলে গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়।

জানা গেছে, ঢাকায় ‘মাজহার’ নামে জসিমের এক সহযোগী তাদের সহায়তা করতেন। তার সঙ্গে সিঙ্গাপুরে ফেরত এবিটির ‘অনুসারী’ সাইফুল ইসলামের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এ চক্রের সদস্যরা সিঙ্গাপুরে ফান্ড সংগ্রহ করতে ধর্মভীরু প্রবাসী এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাদের গ্র“পের নাম ছিল ‘লা মাজহাব’। এ গ্রুপটি সিঙ্গাপুরে যাদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করত তাদের তালিকাও পাওয়া গেছে। এদের সঙ্গে জামায়াতের এক নেতার কানেকশনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বুধবার সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২৭ বাংলাদেশীকে তারা গ্রেফতার করে, যারা সে দেশে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। তাদের মধ্যে ২৬ জনকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এদের মধ্যে ১৪ জনের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পান গোয়েন্দারা। এরা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। বাকিদের মুচলেকা নিয়ে পরিবারের জিম্মায় দেয়া হয়। জানা গেছে, এদের ওপর ২০১৩ সাল থেকেই নজরদারি শুরু করে সিঙ্গাপুরের আইনশৃংখলা বাহিনী।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ‘মাজহার’ ঢাকা থেকে প্রায়ই সিঙ্গাপুরে যেতেন। বিশেষ করে প্রতি রোববার সিঙ্গাপুরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বৈঠক হতো। মাসে দু-একবার ওই বৈঠকে মুফতি জসিমের বার্তা নিয়ে যেতেন মাজহার। এবিটির ১৪ জন ‘অনুসারী’ সিঙ্গাপুরে প্রবাসী ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশী মুসলমানদের ব্রেনওয়াশ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। আর এতে প্রথম সংগঠক হিসেবে কাজ করেন সাইফুল। তিনি ঢাকায় মুফতি জসিমের বয়ান শুনতে মোহাম্মদপুরের বসিলা রোডের একটি মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া করতেন। তখন থেকেই উগ্রপন্থী চেতনায় বিশ্বাসী সাইফুল। তার মাধ্যমেই সিঙ্গাপুরে এবিটির ‘বীজ বপন’ হয়। গ্রুপটি সিঙ্গাপুরে ড. জাকির নায়েক, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মুফতি জসিমের বয়ান শুনতেন এবং প্রচার করতেন।

গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, সাইফুল এবিটির গোড়ার দিকের সদস্যদের প্রায় সবাইকে চিনতেন। বিশেষ করে বিদেশ ফেরত কয়েকজন জঙ্গির সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল। এর মধ্যে ইয়েমেন ফেরত জঙ্গিও আছে। বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যার পর এবিটির সদস্যদের দমনে আইনশৃংখলা বাহিনী সক্রিয় হওয়ার পর এদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। এই আত্মগোপনে থাকা কয়েকজনই সিঙ্গাপুরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের রূপ দেয়। এরাই সিঙ্গাপুরে জঙ্গিদের গডফাদার হিসেবে কাজ করে। এদের সঙ্গে জামায়াতের এক নেতার যোগসূত্রের তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জানা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কারাবন্দি নেতা মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী রেদওয়ানুল আজাদ রানা, নাঈম, তামিম আল আদনানী, আবদুল করিম জাবের, মাইনুদ্দীন শরীফ, তেহজীব করিম ও রেজওয়ান শরীফ সিঙ্গাপুরে জঙ্গিদের নেপথ্যে আছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মাইনুদ্দীন, তেহজীব ও রেজওয়ান ২০১০ সালে ইয়েমেনে আল কায়দাবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এদের দু-একজনসহ মোট পাঁচ জঙ্গি মালয়েশিয়ায় আত্মগোপন করে আছেন। এরা সেখান থেকেই বাংলাদেশে কলকাঠি নাড়ছেন। ঢাকায় মাজহার তাদের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন। ‘মাজহার’ ছদ্মনাম বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। তাকে নজরদারিতে আনার চেষ্টা চলছে।

মাইনুদ্দীন শরীফ, তেহজীব করিম ও রেজওয়ান শরীফকে ইয়েমেনে গ্রেফতারের পর বাংলাদেশে তাদের ফেরত পাঠানোর আগে পশ্চিমা গোয়েন্দারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরাও এবিটির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। এ তিনজন ড্রোন প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। এরা ইয়েমেনভিত্তিক আল কায়দার নেতা আনওয়ার আল আওলাকিকেও অনুসরণ করে থাকেন। আল কায়দা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা নামে একটি গোষ্ঠীর প্রধান আওলাকি ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলায় ইয়েমেনে মারা যান।

এদিকে সিঙ্গাপুরে পুলিশের কাছেও গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছিলেন তারা আল কায়দার নেতা আনওয়ার আল আওলাকির উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। গোয়েন্দারা আরও জানান, সিঙ্গাপুর ফেরত নিষিদ্ধ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া চাঞ্চল্যকর তথ্য খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে তার অফিস কক্ষে সাংবাদিকদের বলেন, গ্রেফতারকৃতরা সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে ফান্ড সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করছিল। এরা মূলত এবিটির সদস্য এবং তাদের নেতা জসিম উদ্দিনকে মুক্তির জন্য ফান্ড সংগ্রহ করছিল বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। আইএস বা আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের বিষয়ে প্রমাণ মেলেনি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, সিঙ্গাপুর ফেরত ১৪ জন আনসারুল্লাহর অনুসারী। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর ১৪ জনকে কারাগারে রাখা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা সেন্টারের কাছে একটি মসজিদে নামাজ পড়তেন তারা। সেখানে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের অন্য সদস্যদের বয়ানে অনুপ্রাণিত হয়ে তারাও আস্তে আস্তে অনুসারী হয়। মনিরুল বলেন, সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে এদের প্রায় কেউই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে জামায়াতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন কয়েকজন আছেন। মনিরুল ইসলাম আরও জানান, বাংলাদেশীরা সিঙ্গাপুর থেকে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে উগ্রপন্থী দলসহ বিভিন্ন কাজে টাকা পাঠাতেন।

এদিকে সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে গ্রেফতার ব্যক্তিরা কয়েকটি ইসলামী দল ও তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। পাঠচক্রের তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের জন্য লোকদের তারা উৎসাহিত করত। এদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উগ্রবাদী ও জিহাদিসামগ্রী বিশেষ করে বই, ভিডিও এবং শিশুদের সন্ত্রাসী সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়ার ফুটেজসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। কিছু কিছু সদস্য নীরবে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর গ্রাফিক চিত্র ও নির্দেশনার বিনিময় করেছে। এতে বিভিন্ন পদ্ধতি ও অস্ত্রের কথা রয়েছে।

২৭ বাংলাদেশী সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি ছিল বলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং বুধবার রাতে তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইটস টাইমস অনলাইনে এ পোস্টের তথ্য উল্লেখ করা হয়। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ওই দলের কয়েকজন সদস্য বিশ্বাস করেন যে ইসলামের পক্ষে সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ করা উচিত। কয়েকজন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সশস্ত্র জিহাদে অংশ নেয়ার কথাও ভাবছিলেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ যুগান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের আহতদের পুনর্বাসনের নামে সিঙ্গাপুরে অর্থ সংগ্রহ করতেন ১৪ জঙ্গি। এদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। আবারও তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি জানান, ১৪ জন গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে রয়েছে। বাকি ১২ জনকে পরিবারের জিম্মায় দেয়া হলেও তাদের পুলিশের বিশেষ শাখা নজরদারি করছে।

ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হলেন- ঢাকার সাইফুল ইসলাম, টাঙ্গাইলের আমিনুর, আবদুল আলীম, শাহ আলম, কুমিল্লার গোলাম জিলানী, মাহমুদুল হাসান, নুরুল আমিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাফর ইকবাল, ঝিনাইদহের আকরাম হোসেন, চুয়াডাঙ্গার আবদুল আলী, পাবনার আশরাফ আলী, কুড়িগ্রামের আলম মাহবুব, মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ জসীম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডলার পারভেজ। যাচাই বাছাই শেষে যে ১২ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তারা হলেন- খুরশীদ আলম, মোফাজ্জল হক, ফারুক হোসেন, সজীব হোসেন, শেখ খোরশেদ আলী জুয়েল, আল মামুন, রেজাউল করিম, আমজাদ হোসেন, ফয়েজ উদ্দিন, সরদার পলাশ, সুজন শাহ আলম, সুমন মো. জাকারিয়া হোসেন ও রেজাউল হোসাইন।

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুর পুলিশ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে যাদের ফেরত পাঠিয়েছে এরা বিভিন্ন সময় শ্রমিক হিসেবে সিঙ্গাপুর যান। এদের অনেকে ১০ বছরের বেশি সময় দেশটিতে ছিলেন। তারা সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মার্কেটের কাছে অ্যাঙ্গোলিয়া নামে একটি মসজিদে সপ্তাহে বৈঠকে বসতেন।

এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মাহবুব উজ জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি আপনারা দেখেছেন। তাদেরকে আস্তে আস্তে ঘটনার পরিক্রমায় এই পর্যায়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের সংখ্যা ২৬ জন। এদেরকে সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষ মনিটর করেছে, নজরদারি করেছে। তারপর সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৪ জনকে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের পুলিশ পুরো বিষয়টি তদন্ত করবে, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হবে।’

Staff Reporter
ADMINISTRATOR
PROFILE

Posts Carousel

Latest Posts

Top Authors

Most Commented

Featured Videos