জয়পুরহাটের হিমাগারে ৩৪ লাখ বস্তা আলু, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি

জয়পুরহাটের হিমাগারে ৩৪ লাখ বস্তা আলু, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি

জয়পুরহাট, বাংলাদেশে আলু উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এই জেলার আলুর গুণগত মান অত্যন্ত ভালো হওয়ায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়। তবে, এবারের মৌসুমে উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারের দর স্থির না থাকায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এই আলু এখন তাদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। জেলার ২১টি হিমাগার

জয়পুরহাট, বাংলাদেশে আলু উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এই জেলার আলুর গুণগত মান অত্যন্ত ভালো হওয়ায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়। তবে, এবারের মৌসুমে উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারের দর স্থির না থাকায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এই আলু এখন তাদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

জেলার ২১টি হিমাগার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সময়ে হিমাগারে মজুত রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫১ বস্তা আলু। যদি গড়ে ৮৫০ টাকা লোকসান ধরে হিসাব করা হয়, তবে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি, গত মৌসুমে হিমাগার থেকে ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৬ বস্তা আলু বিক্রি হয়েছিল, যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে, আলু বিক্রি না হওয়া ও সংরক্ষণের কারণে মোট ক্ষতি ছুঁয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে আলু কেনার কোনও উদ্যোগ না থাকায় তারা গভীর আর্থিক সংকটে পড়েছেন। এছাড়া, বাজারে আলুর দাম না বাড়া এবং ক্রেতার অভাবের কারণে হিমাগারে জমে থাকা আলু বিক্রি করতে গিয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে জেলায় ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১০ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে, ২ লাখ ৬ হাজার ৭১৬ মেট্রিক টন বা ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৬ বস্তা আলু সংরক্ষণ করা হয় ২১টি হিমাগারে। বর্তমানে, এখনো ৮২ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন বা ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা আলু হিমাগারে পড়ে রয়েছে।

সরেজমিনে বিভিন্ন হিমাগার পরিদর্শন করে জানা গেছে, নভেম্বর-ডিসেম্বরে নতুন মৌসুমে আলু রোপণের প্রস্তুতি চলছে, কিন্তু পুরোনো আলু এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। হিমাগারগুলোতে সংরক্ষণকালে শেষ তারিখ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব আলু তুলতে না পারলে সংরক্ষণ মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। বর্তমান বাজারমূল্যে আলু বিক্রি করলে প্রতিটি বস্তায় অন্তত ১০৫০ থেকে ১০৭০ টাকা লোকসান গুনতে হবে, যার কারণে কেউই আলু তুলতে আগ্রহী নন।

সদর উপজেলার সোটাহার ধারকী গ্রামের কৃষক ফেরদৌস মোল্লা বলেন, সার সিন্ডিকেটের কারণে তিনি সার পান না। এক বস্তার জন্য ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ওপরে দামে সার কিনতে হয় এবং সেচের জন্যও বিভিন্ন ছত্রছায়া সিন্ডিকেটের ভয় কাজ করে। ঋণ করে ফসল ফলিয়েও ন্যায্য দাম পান না। মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগও আঘাত হানে। এদিকে, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন আর কর বাড়ছে, কিন্তু কৃষকের ভাগ্য ভালো নয়। তারা আন্দোলনও করতে পারে না।

আব্দুল আলিম আকন্দ, এক স্থানীয় আলু ব্যবসায়ী, বলেন, ভালো দামের আশায় তিনি ৪ হাজার বস্তা আলু ৫৬ লাখ টাকায় কিনেছিলেন। কিন্তু দাম পড়ে গেলে এখন বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায়, যার ফলে প্রায় ৫১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সঞ্চয় সবশেষ হয়ে গেছে।

কালাই উপজেলা ও অন্যান্য এলাকার হিমাগারগুলোতেও একই পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কালাইয়ের এম ইসরাত হিমাগারে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ৫ হাজার ২৬০ জন আলু সংরক্ষণ করেছিলেন। এই হিমাগারে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮ কোটি টাকার বেশি।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক প্রদীপ কুমার প্রসাদ জানান, দুই লাখ ৬০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষিত ছিল। দেরি হওয়ায় তা বের করার সময় শেষের দিকে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নেন না কারণ তাঁদের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে, ক্ষেতলাল উপজেলার আলু ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান মিলন বলেন, উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত একজন আলু ব্যবসায়ীর প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে প্রায় ২৪-২৫ টাকা। বর্তমানে সরবরাহের অভাবে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৯-১০ টাকায়, অর্থাৎ প্রতি কেজিতে তার ক্ষতি হয় ১৬ টাকা।

একজন ব্যবসায়ী মিঠু ফকির জানিয়েছেন, তিনি ১২ হাজার বস্তা আলু রাখা ছিলেন। এর মধ্যে ১০ হাজার বস্তা বিক্রি করেছেন, বাকি দুই হাজার এখনো হিমাগারে। ক্ষতির পরিমাণ প্রতি বস্তায় ৯০০ টাকা মানলে মোট প্রায় ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

শিক্ষিত কৃষক-ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, দীর্ঘকাল ধরে এই ক্ষতি চোখে দেখা যায়নি। কৃষক রকিব উদ্দিন মন্ডল বলেন, তিনি ১ হাজার ২০০ বস্তা আলু চাষ করেছিলেন, যার ফলে ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সদর উপজেলার রায়হান আলম বলেন, সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম আলুর দাম কেজিপ্রতি ২২ টাকা হলেও বাজারে তা কার্যকর হয়নি। প্রশাসনের কার্যক্রম শক্ত না থাকায় দাম কমতেই থাকছে। বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ আলু হিমাগারে পড়ে রয়েছে। এতে কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ এ কে এম সাদিকুল ইসলাম জানান, গত বছর আবাদের চাহিদার চেয়ে বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছিল, ফলে দাম কমে যায়। সরকার ২২ টাকা দরে কেজি মূল্য নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয়নি। ক্ষমতাধররা যথাযথ মনোযোগ না দিয়ে এই পরিস্থিতি আরও অবনতি করছে।

জয়পুরহাট কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান বলেন, বাজারে বেশি উৎপাদনের কারণে সরবরাহ বেড়েছে। সরকারিভাবে আলু কেনার সিদ্ধান্ত হলেও এখনও কোনও নির্দেশনা আসেনি। রপ্তানি ও বিকল্প বাজার খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।

উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গত ৫ সেপ্টেম্বর আক্কেলপুরে ঘোষণা দেন, সরকারিভাবে আলু কেনা হবে এবং টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। তিনি কেজিপ্রতি ২২ টাকায় আলু কেনা ও রপ্তানির আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি, ফলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা নির্বাক হয়ে পড়েছেন।

Staff Reporter
ADMINISTRATOR
PROFILE

Posts Carousel

Latest Posts

Top Authors

Most Commented

Featured Videos